সাইদ ইবনে সামস: ফুটবল এমন একটি খেলা যেখানে ইতিহাস হাত দিয়ে নয় পা দিয়ে লেখা হয়, কিন্তু এই কথাটি বাংলাদেশের জন্য হয়তো না। আমরা যেন কোনোভাবেই ইতিহাস লিখতে পারছি না। যাই হোক আজকের প্রসঙ্গ কাজী সালাহউদ্দিন। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের বর্তমান সভাপতি আবার ঘোষনা দিয়েছেন ৫ম বারের মত বাফুফের সভাপতি নির্বাচন করবেন। যেখানে বাংলাদেশ ফুটবলের সমর্থক গুষ্টির একটি অংশ চাচ্ছেন তিনি পদত্যাগ করে নির্বাচন থেকে সরে দাড়াক, সেখানে তিনি সংবাদ মাধ্যমগুলোতে বলে বসলেন কারো হুমকিতে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাড়াবেন না। সালাহউদ্দিন তাহলে আর কবে সরবেন?

যাই হোক শুরু করা যাক সালাহউদ্দিন সাহেবের এক ইন্টারভিউর কথা দিয়ে, ৩১ জুলাই ২০০৬ সালে ততকালীন বাফুফের সভাপতি এসএম সুলতানের বিপক্ষে আওয়াজ তুলে বাফুফের সহসভাপতি পদ থেকে সরে দাড়ান কাজী সালাহউদ্দিন। নিজের এক ইন্টারভিউতে তিনি বলেছিলেন, “He is unethical, morally corrupt. It is simply impossible for me to work under the same roof with a complete liar like him.” এমনই এক বার্তা দিয়ে সরে দাড়িয়েছিলেন। এরপর নিজেই নির্বাচন করে বাফুফে সভাপতি হন তিনি। ২০০৮ সালে তিনি বাফুফের সভাপতির দায়িত্বে আসেন। এই সময়ে সিটিসেলের সাথে তিন বছরের একটি চুক্তি করে বাংলাদেশের ফুটবলে ইতিহাস রচনা করেন তিনি। প্রায় ১৬ কোটির টাকা একটি চুক্তি করেন তিনি সিটিসেলের সাথে।

অক্টোবর ২০০৯ সালে তিনি সাফের প্রেসিডেন্টও নির্বাচিত হন। তখন থেকে এখন পযর্ন্ত চার বার সাফের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আছেন বাংলাদেশের প্রথম সুপার স্টার খ্যাত এই ফুটবলার। ২০০৯ সালে তিনি ফিফার ট্যাকনিক্যাল এবং ডেপোলোপমেন্ট কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।

২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল দীর্ঘ ১৬ বাফুফের সভাপতির দায়িত্বে আছেন। ব্যর্থতার গল্প হয়তো লিখতে গেলে শেষ হবে না। ১৬ বছরের দায়িত্বে এখন পযর্ন্ত একটি ভালো মানের একাডেমি করতে পারেননি। জাতীয় দলের কোনো পাইপলাইন প্রস্তুত করতে পারেননি। গত বছর এপ্রিলে ফিফা থেকে নিষিদ্ধ হয়েছেন তার অধীনে থাকা সাধারন সম্পাদক আবু নাইম সোহাগ। সালাম মূর্শীদি ১৩ লক্ষ টাকা জরিমানা পেয়েছেন ফিফা থেকে। তিনি ইতিমধ্যে দায়িত্ব থেকে সরে দাড়িয়েছেন। বাফুফের অনেক প্রশাসনিক ও আর্থিক বিষয়ে প্রশ্ন তুলে দায়িত্ব থেকে সরে দাড়িয়েছিলেন নির্বাহী কমিটির সদস্য সাবেক অধিনায়ক আরিফ হোসেন মনু।

যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় থেকে প্রায় ২০ কোটি টাকা পেয়েছিলো বাফুফে কিন্তু প্রথম বার ১০ কোটিই নিয়মবহির্ভূতভাবে খরছ হওয়ায় সমালোচনার মুখে পড়ে বাফুফে। সাংবাদিকদের কয়েকবার আশা দিয়েছেন সালাহউদ্দিন সাহেব যে প্রতিষ্ঠানের হিসাবগুলো বাফুফের ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে যা এখনো পাওয়া যায় না।

ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশকে ১৫০ এর উপরে তুলবেন বলেও এখন ভুটান ও মালদ্বীপের নিচে অবস্থান করছে বাংলাদেশ দল। কাজী সালাহউদ্দিনের সময়ে বাংলাদেশ জাতীয় পুরুষ দল কোনো সাফল্যর দেখা পায়নি। ২০০৩ সালে পর আর সাফে শিরোপা তো জিততে পারে নি, ২০০৫ সালে পর আর ফাইনালও খেলেনি বাংলাদেশ দল। নারী ফুটবল উন্নতি করলেও পুরুষ দলের ব্যর্থতার দায় এড়ানোর সুযোগ নেই তার। ব্যর্থার কথা বলার সময় এইটাও বলতে হয় যে অতীতের চেয়ে জাতীয় দল সুযোগ-সুবিধা বেশি পেয়েছে কাজী সালাহউদ্দিনের সময়ে। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলকে অনুশীলন ক্যাম্পের জন্য কাতার, সৌদি আরবে পাঠিয়েছেন তিনি। পাঁচ তারকা হোটেলে রেখেছেন দলকে। আয়োজন করেছেন অনেক আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ। কোচ নিয়োগে বার বার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন কাজী সালাহউদ্দিন। টম সেইন্টফিট ছাড়া তার অধীনে আসা কোনো কোচেরই আগে জাতীয় দলের কোচিং করানো অভিজ্ঞতা ছিলো না। বাফুফে সভাপতি হিসেবে জাতীয় দলের ব্যর্থতার দায় এড়ানোর সুযোগ নেই তাঁর।

তার এই ১৬ বছরের সভাপতিত্বের সময়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিলো দীর্ঘমেয়াদী কোনো পরিকল্পনাই ছিলো না তার। পরিকল্পনা ও ধারাবাহিকতা কিছুই ছিলো না বলতে হয়। বিদেশী কোচ এনেছেন আর বিদায় করেছেন, প্রথম আলোর রিপোর্ট অনুযায়ী ১২ বছরে হ্যাভিয়ের ক্যাবরেরা বাংলাদেশের ১২ তম কোচ। এবং দেশের মাটিতে সর্বশেষ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের পর সাংবাদিকদের বলেই বসেন তিনি থাকলে আর ক্যাবরেরাকে রাখবেন না।

একাডেমির কথাই ফেরা যাক। দীর্ঘ ১৬ বছরে কি একটি একাডেমি করার সুযোগ হয়নি তার? ফিফা থেকে অর্থায়ন পেয়ে সিলেটে একটি একাডেমি করলেও চালাতে পারেননি। সর্বশেষ কমলাপুর স্টেডিয়ামে ৫০-৬০ জন ফুটবলার নিয়ে একটি কার্যক্রম শুরু করে নাম দিয়েছেন বাফুফে এলিট একাডেমি। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগের ক্লাবগুলোর এখনো একাডেমি নেই। সর্বশেষ অনূর্ধ্ব-১৮,১৬ টুর্নামেন্ট আয়োজন করে বাফুফে। বসুন্ধরা কিংস সভাপতি ও বাফুফের লীগ কমিটির চেয়ারম্যান ইমরুল হাসান দায়িত্বে আসার পর এই টুর্নামেন্ট আয়োজন করেন তিনি। কিন্তু এখানে ক্লাবগুলো ট্রায়াল নিয়ে অথবা কোনো নিয়মিত একাডেমির একটি দল নিয়েই খেলে ফেলছে। যা পেশাদার ফুটবলে দেখা যায় না।

বাফুফের জেলা লীগ কমিটির চেয়ারম্যান কাজী সালাহউদ্দিন। কিন্তু সর্বশেষ দুই বছরে এই কমিটির কোনো সভাই হয়নি। জেলা লীগগুলো অবহেলিত রয়ে গিয়েছে। তাহলে নতুন ফুটবলার উঠে আসবে কিভাবে প্রশ্ন উঠছে? জেলা ফুটবল অ্যাসেসিয়েশনগুলোকে অর্থ দিলেও সক্রিয় করতে পারেননি তিনি।

এমন আরো ব্যর্থতার গল্প লেখা যাবে তাকে নিয়ে, ১৫ বছরের এই সময়ে দেশের ফুটবলের চেহারা পরিবর্তন করার সুযোগ ছিলো তার কাছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু তিনি ১৫ বছরে কিছু করতে পারেননি। এই ব্যর্থতার দায় নিয়ে হলেও এইবারের নির্বাচনের না দাড়ানোর সিদ্ধান্ত তিনি নিতেই পারতেন। কিন্তু তিনি আবারো সভাপতির চেয়ারে বসতে চান, আবারো দেশের ফুটবলের নেত্বতেৃ আসতে চান, আমাকে আবার লিখতে হচ্ছে, ফুটবল এমন একটি খেলা যার ভাগ্য লেখা হয় পা দিয়ে, যার সুযোগ আমরা পাচ্ছিই না। কবে সরবেন কাজী সালাহউদ্দিন?

Previous articleশঙ্কায় বাফুফের দুই টুর্নামেন্ট
Next articleমারুফুলের চূড়ান্ত দল ঘোষণা!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here