বর্তমানে বাংলাদেশ ফুটবলকে ‘অক্সিজেন‘ দিয়ে কোনরকম ভাবে বাঁচিয়ে রেখেছে নারী ফুটবলাররা! পুরুষ ফুটবল দলের যেখানে বছরের পর বছর ধরে র‍্যাংকিংয়ে অবনতি হয়েছে এবং হচ্ছে, সেখানে নারীরাই দেশের ফুটবলকে টিকিয়ে রাখতে পেরেছে। বয়সভিত্তিক পর্যায়ে বরাবরই সফল নারীরা দেশকে এনে দিয়েছে কতো কতো ট্রফি, যে ট্রফি জাতীয় দলের কাছে সোনার হরিণ! নারীরা পারলে কেন পুরুষ দল পারছে না?

তার হাত ধরেই যে বদলে গেল দেশের নারী ফুটবল। বলে ঠিকভাবে লাথি দিতে না পারা মেয়েরাই আন্তর্জাতিক আসরে ট্রফি জয় করতে শিখল। বয়সভিত্তিক পর্যায়ে তো বাংলাদেশ এখন মাঠে নামা মানেই গোল উৎসব। দক্ষিণ এশিয়ার গণ্ডি পেরিয়ে সমগ্র এশিয়াতেই বাংলাদেশ সেখানে আলাদা করে প্রতিষ্ঠা করেছে নিজেদের। দেশে তৈরি হয়েছে নারী ফুটবলের জাগরণ। জাগরণের এই অধ্যায়ে নায়কের ভূমিকায় থাকবেন অনেকেই। যাদের উদ্যোগে সামাজিক রক্ষণশীলতার চোখ রাঙানি দূরে ঠেলে মাঠে মেয়েদের ফুটবল গড়াল, যে মেয়েরা সাহস করে প্রথম মাঠে নামল; তারা তো আজীবন করতালির দাবি রাখে। কিংবা এভাবেও বলা যায়, আজ মেয়েদের প্রতিটি সাফল্য মানে তাদের সাফল্য। তর্কসাপেক্ষে এই সাফল্যের পেছনে একাধিক নামই হয়তো আসবে। কিন্তু একটা জায়গায় অন্য সবাইকে পেছনে ফেলে দেবেন গোলাম রাব্বানী ছোটন।

২০০৯ সালে নারী ফুটবলের দায়িত্ব নিয়ে যে কাজটা নিপুণভাবে করে যাচ্ছেন ছোটন। এই জায়গাটায় আবার তিনি শুধুই একজন কোচ নয়, একজন অভিভাবকও। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ছোটন কাজটা করে গেছেন নিভৃতে। কারণ নারী ফুটবল তখনো সেভাবে আলোড়ন ফেলতে পারেনি। বাংলাদেশের মেয়েরা আন্তর্জাতিক ফুটবলেও খেলছেন, এটাই তখন পর্যন্ত তৃপ্তি। কিন্তু ২০১৫ সাল থেকেই চিত্রটা বদলাল। ছোটনের কোচিংয়ে সে বছর নেপালে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হলো বাংলাদেশ। মেয়েদের ফুটবল ইতিহাসে যা বাংলাদেশের প্রথম ট্রফি জয়।

এরপর যেন শুধুই একটা ঘোর লাগা সময়। ২০১৬ সালে তাজিকিস্তানে হওয়া এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক ফুটবলেও চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। তার চেয়ে বড় বিস্ময়টা দর্শক উপহার পেল একই বছর সেপ্টেম্বরে ঘরের মাঠে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবলের বাছাই পর্বে। প্রতিপক্ষকে গোলের পর গোলে ভাসাল কৃষ্ণা, সানজিদা ও মৌসুমীরা। জায়গা করে নিল এফএসফি অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে। সে পর্ব এশিয়া সেরা আট দলের মঞ্চ। যেখানে আবার সেরা তিন দলে থাকতে পারা মানে অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ^কাপ ফুটবলে কোয়ালিফাই করা। একবার নয়, এশিয়ায় সেরা এই মঞ্চে এরই মধ্যে দুবার খেলে ফেলেছে বাংলাদেশ। বাছাই পর্বের ধাপ পেরিয়ে ২০১৭ সালের পর ২০১৯ সালেও এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ প্রতিযোগিতার মূল পর্বে খেলে লাল-সবুজের মেয়েরা। সেখানে শক্তিধর প্রতিপক্ষের সঙ্গে যে একেবারেই নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে পারেনি বাংলাদেশ তা নয়। ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার মতো ফুটবল শক্তির বিপক্ষে সমানে সমালে লড়াই করে হারতে হয়েছিল সানজিদাদের। দুই বছর পর সেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই ড্র নিয়ে ফিরে তহুরা-মনিকারা। যে ম্যাচে আসলে জয়টাই প্রাপ্ত ছিল বাংলাদেশের।

মাঝের সময়টায় দক্ষিণ এশিয়ার মঞ্চেও দাপট দেখিয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো আয়োজিত সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয় মারিয়া মান্দা, আঁখি খাতুনরা। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে হয় রানার্সআপ। ২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো আয়োজিত সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ ফুটবলেও চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। একই বছর হংকং থেকে ফেরে আন্তর্জাতিক জকি কাপের শিরোপা জয় করে। সিনিয়র জাতীয় দলে অবশ্য এই পারফরম্যান্সের ছটা সেভাবে লাগতে শুরু করেনি। এরপরও ছোটনের কোচিংয়ে ২০১৬-১৭ সালে সিনিয়র সাফ প্রতিযোগিতায় রানার্সআপ হয় বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক সময়েও গত নভেম্বরে ঘরের মাঠে অনূর্ধ্ব-১৯ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ।

কিন্তু বয়সভিত্তিক পর্যায়ে সফল হলেও জাতীয় দলে এসেই খেই হারিয়ে ফেলে মেয়েরা। কেনো তাদের এমনটা হয়? হয়তো তাদের এখানটায় মূল সমস্যাটা কোচ গোলাম রাব্বানী ছোটন! অবাক হচ্ছেন? বাংলাদেশের নারী ফুটবলের জাগরণের অগ্রদূত ছোটন আবার নারী দলের জন্যই সমস্যা হন কিভাবে? কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।

বাংলাদেশের প্রতিটা বয়সভিত্তিক নারী দলকে নিজ হাতে সামলান গোলাম রাব্বানী ছোটন। সামলানোর সাথে সাথে নিয়মিতই দলকে এনে দিয়েছেন সাফল্য। কিন্তু জাতীয় দলে সেই ছোটনই আবার ব্যার্থদের কাতারে। তাহলে কি কোচ গোলাম রাব্বানী ছোটনের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে বাফুফে? তাকে দিয়েই কেন নারীদের সবগুলো দল চালাতে হবে? ছোটনকে শুধুমাত্র বয়সভিত্তিক দলগুলোতে দায়িত্বে রেখে জাতীয় দলের জন্য কি আলাদা কোচ নিয়োগ দেওয়া যায় না?

গোলাম রাব্বানী ছোটনের যোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকার কথা নয়। কিন্তু কথা হলো একজন কোচ যদি এতগুলো দল একসাথে সামলান সেক্ষেত্রে তার পরিকল্পনা সাজাতেও নিশ্চয়ই ঝামেলায় পড়তে হয়। এছাড়া ফুটবলাররাও একজন কোচের অধীনে খেললে তারাও নতুন নতুন অনেক কিছু শেখার সুযোগ হারান। তাইতো সাফল্য পেতে হলে গোলাম রাব্বানী ছোটনের জায়গায় জাতীয় দলের দায়িত্বে ‘হাই প্রোফাইল‘ একজন কোচ নিয়োগ দেওয়া সময়ের দাবি। কেননা বাংলাদেশ নারী বয়সভিত্তিক দলগুলো থেকে উঠে আসা ফুটবলারদের আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সেটারই বড্ড প্রয়োজন। গোলাম রাব্বানী ছোটনের কাঁধে শুধুমাত্র প্রতিভা খোঁজা আর বয়সভিত্তিক দলগুলোর দায়িত্ব দিয়ে জাতীয় দলের দায়িত্ব দেশী কোনো ভালো কোচ বা বিদেশি ‘হাই প্রোফাইল‘ কারো কাঁধে দিতে পারলে নিশ্চিতভাবেই নারী ফুটবল আরো এগিয়ে যাবে। কিন্তু সবসময় উল্টো নীতিতে বিশ্বাসী বাফুফে কি সেই পথে হাঁটবে? নাকি ছোটনের ওপর ভরসা রেখেই কাজ চালিয়ে দেবে? সময়ই বলে দেবে সব কিছু।

Previous articleআবারো র‍্যাংকিংয়ে পেছলো বাংলাদেশ
Next articleলালমনিরহাটের শ্রেষ্ঠত্বে পর্দা নামলো জেএফএ অনূর্ধ্ব-১৪ নারী ফুটবল টুর্নামেন্টের

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here