“মুন্না ওয়াজ মিসটেকেইনলি বর্ন ইন বাংলাদেশ”- এই কথাগুলো বলেছিলেন বাংলাদেশের সাবেক ফুটবল কোচ অটো ফিস্টার। আর যার সম্পর্কে কথাগুলো বলেছিলেন তিনি বাংলাদেশ দলের কিংবদন্তি ফুটবলার মোনেম মুন্না, যার খ্যাতি ছিলো পুরো দেশজুড়ে। দেশজুড়ে বললে ভুল হবে দেশের গন্ডি পেরিয়ে ভারতের মাটিতেও সফল পদচারণা ছিলো মোনেম মুন্নার। আজ ১২ ই ফেব্রুয়ারী, মোনেম মুন্নার ১৯ তম মৃত্যুবার্ষিকী।
মোনেম মুন্না স্বভাবতই ছিলেন একজন ডিফেন্ডার। খেলেছিলেন সত্তর-আশির দশকে বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলের সোনালী সময়ে। ফুটবলে মূলত স্ট্রাইকার কিংবা মিডফিল্ডারদেরই জয়ধ্বনি দেওয়া হয়। ডিফেন্ডারদের অবদান সেখানে প্রদীপের নিচের অন্ধকারের ভীড়ে হারিয়ে যায়। তবে একজন ডিফেন্ডার হয়েও যে সমহিমায় উজ্জ্বল হওয়া যায় সেটি করে দেখিয়েছেন মোনেম মুন্না। দেশের মানুষ তো বটেই ভারতীয় ফুটবল ভক্তদের মনেও জায়গা করে নিয়েছিলেন এই সেন্টার ব্যাক। কিন্তু দেশের মানুষ কয়জনই বা মনে রেখেছে খ্যাতনামা এই ফুটবলারকে। জন্মবার্ষিকী কিংবা মৃত্যুবার্ষিকী বাদ দিয়ে কয়জনই বা মনে করে মোনেম মুন্না নামক কীর্তিমানের নাম।
মোনেমা মুন্না ১৯৬৮ সালের ৯ ই জুন নারায়ণগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকে তার ফুটবলের প্রতি বিশেষ এক ধরনের টান ছিলো। মাত্র ১৪ বছর বয়সে, সে সময় তিনি বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের বিপক্ষে নারায়ণগঞ্জের হয়ে খেলছিলেন। সেদিন তাকে মাঠে নামতে দেখেন অবাক হয়েছিলেন বাফুফের কর্তারা। ধারণা করেছিলেন এই বাচ্চা ছেলেটা জাতীয় দলের বিপক্ষে কতটুকু কি করতে পারবে। কিন্তু বাচ্চা ছেলেই সেদিক সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। নিজের খেলার দ্বারা সবাইকে বার্তা দিয়েছিলেন তিনি আসছেন।
১৯৮০-৮১ মৌসুমে মাত্র ১২ বছর বয়সে পাইওলিয়ার লীগের দলের দল শুলশান ক্লাবে হয়ে নিজের ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। পরের মৌসুমে গুলশান ক্লাব ছেড়ে শান্তিনগরে যোগ দেন। পরবর্তী মৌসুমে আবারো দল বদল করেন মুন্না। যোগ দেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ তখন ঘরোয়া ফুটবলে দ্বিতীয় বিভাগে খেলতো। ১৯৮৩ সালে মৌসুমে মুক্তিযোদ্ধাকে দ্বিতীয় বিভাগ লীগে চ্যাম্পিয়ন করতে বড় ভূমিকা রাখেন মোনেম মুন্না। ১৯৮৪-৮৫ মৌসুমে মুক্তিযোদ্ধার হয়ে প্রথম বিভাগে পদচারণা হয় মোনেম মুন্নার। প্রথম বিভাগেও নিজের নৈপুন্য ধরে রাখতে সক্ষম হন তিনি। এরপর দল বদলে ১৯৮৬ সালে যোগ দেন ব্রাদার্স ইউনিয়নে। ব্রাদার্সের হয়েও দুর্দান্ত খেলেছিলেন তিনি। ব্রাদার্সের হয়ে তার নজরকাড়া পারফরম্যান্স আবাহনীর কর্তাব্যক্তিদের নজরে আসেন। তখন আবাহনীতে দেশের সব তারকা ফুটবলাররা রয়েছে। আশরাফ উদ্দিন চুন্ন, গোলাম রাব্বানী হেলাল, আসলামের মত তারকারা তখন দেশের ফুটবলে রাজত্ব করছিলেন সাথে আবাহনীও। আবাহনী কর্তারা ১৯৮৭ সালে মোনেম মুন্নাকে আকাশী নীল জার্সিতে নিয়ে আসেন আবাহনীর কর্তারা। তখন মুন্নার বয়স ১৯ বছর। আবাহনীতে নিজেকে আরো পরিণত করেন এই তারকা ফুটবলার। আবাহনীকেই বানিয়ে নেন নিজের ঘর হিসেবে। ক্যারিয়ারের শেষ পযর্ন্ত ছিলেন দেশ সেরা এই ক্লাবটিতে।
১৯৯১ সালে তিনি সুযোগ পান উপমহাদেশের অন্যতম পরাশক্তি কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ক্লাব ইস্টবেঙ্গলে খেলার। ইস্টবেঙ্গলের হয়ে লীগ ও ফেডারেশন কাপ জয়ের কৃতিত্ব রয়েছে মোনেম মুন্না। তার খেলায় কলকাতার দর্শক এবং ইস্টবেঙ্গলের কর্তারা অনেক অবাকই হয়েছিলো। তাকে দেখে কর্তারা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলো মোনেম মুন্নার মত দ্বিতীয় কেউ এই উপমহাদেশে আর জম্ম নিবে না। নিজের সেরা খেলা দেখিয়ে ইস্টবেঙ্গলের ‘হল অফ ফ্যাম’ এ জায়গা করে নিয়েছিলেন বাংলাদেশের এই কিংবদন্তি খেলোয়াড়। মাত্র দুই মৌসুমেই নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে এসেছিলেন কলকাতার মাঠে। ১৯৯১ সালে রের্কড পরিমান অর্থ পেয়েছিলেন মোনেম মুন্না। তখনকার সময়ের ২০ লক্ষ টাকায় ঢাকা আবাহনী স্বাক্ষর করেছিলেন তিনি, যা তখন অনেক বড় ব্যাপার ছিলো। এই রের্কড পরিমাণ অর্থে বিষয়ে চারদিকে সাড়া পড়ে গিয়েছিলো। একজন ডিফেন্ডার হয়েও এতো টাকায় দলভুক্ত হওয়া অনেককেই অবাক করে। মুন্না তখন দেশের ফুটবলে ব্র্যান্ডে পরিনত হয়৷ ১৯৯০ দশকে লাইফবয়ের বিজ্ঞাপনের মডেল ছিলেন মুন্না। জনপ্রিয় ইউনিলিভার কোম্পানির ব্র্যান্ড এম্ব্যাসেডর হয়েছিলেন তিনি।
জাতীয় দলেও নিজের সেরা নৈপুণ্য দেখিয়ে গিয়েছেন মোনেম মুন্না। ১৯৮৬ সালে সিউলে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে প্রথম জাতীয় দলে ডাক পান মুন্না। তখন মাত্র ১৮ বছর বয়সের যুবক মোনেম মুন্না। এরপর ইনজুরি ছাড়া নিজের খেলার জন্য কখনই দলের বাইরে থাকতে হয়নি তাকে৷ ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৭ সাল দীর্ঘ ১১ বছর জাতীয় দলে নিয়মিত ছিলেন তিনি৷ ১৯৯০ সালে বেইজিং এশিয়ান গেমসে প্রথম জাতীয় দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পান মোনেম মুন্না। ১৯৯৫ সালে মিয়ানমারের চার জাতীয় টুর্নামেন্টে মোনেম মুন্নার নেত্বতৃে অংশ নেয় টাইগাররা। তখন বাংলাদেশ দলের কোচ ছিলেন জার্মান অটো ফিস্টার। সেবারই দেশের ফুটবলে প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা আসে। পুরো দলই অসাধারন ফুটবল খেলেছিলো সেই টুর্নামেন্টে, তবে মুন্না খেলা ও নেতৃত্ব আলাদাভাবে সকলের নজরে আসে। ১৯৯৭ সালে নিজের বুট জোড়া তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নেন এই ফুটবলার।
ফুটবল খেলা ছাড়লেও ফুটবলকে ছেড়ে থাকতে পারেননি তিনি। তাই তো খেলা শেষে দায়িত্ব নেন নিজের প্রিয় ক্লাব আবাহনী ম্যানেজার পদের। ১৯৯৯ সালে তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার কিডনিতে সমস্যা দেখা দিলে ভারতে তার বোন শামসুর নাহার আইভির কিডনি তার শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। ২০০৪ সালে আবার তার শরীরে ভাইরাস দেখা দেয়। ২০০৫ সালে ১৭ দিন মৃত্যু সাথে লড়াই করার পর ১২ ফেব্রুয়ারি তিনি পরলোক গমন করেন। মাত্র ৩৯ বছর বয়সে তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন৷ বাংলাদেশের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র মৃত্যুর আগ পযর্ন্ত নিজের প্রানপ্রিয় ক্লাব আবাহনীর ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলেন। পরিশ্রম ও আত্মপ্রত্যয়ী ফুটবলার হিসেবে সবার কাছে পরিচিত ছিলেন মোনেম মুন্না। নেতৃত্ব এবং পেশাদারি মনোভাবের এক জলন্ত উদাহরন ছিলেন তিনি এবং পরিণত হয়েছিলেন উপমহাদেশে একজন আইকনে। তিনি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন যা আসলে লিখে বুঝানো সম্ভব নয়। তার স্মরনে ধানমন্ডি ৮ নম্বরের সেতুটিকে ‘মোনেম মুন্না সেতু’ নামকরন করা হয়।
দেশের উজ্জ্বল নক্ষত্র, দেশের সবচেয়ে বড় তারকা ফুটবলার, দেশের ইতিহাসের সেরা ডিফেন্ডার এবং আমাদের মোনেম মুন্নাকে তার ১৯ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা দিয়ে স্মরন করছি। ‘কিংব্যাক’ বেঁচে থাকুক দেশের শতকোটি ফুটবল ভোক্তার মনে,এটাই শুধু প্রত্যাশা।