ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে গত সোমবার পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। সেদিন বিকেলেই শেখ হাসিনার বড় ভাই শেখ কামালের হাতে গড়া বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ক্লাব ঢাকা আবাহনীতে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। মূল ফটক বরাবর থাকা আবাহনী ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা শেখ কামালের প্রতিকৃতিতে আগুন ধরিয়ে দিলে অর্ধেকের বেশি পুড়ে যায় প্রতিকৃতি। ভাঙচুর করা হয় ক্লাবের অফিস, তছনছ করা হয় ক্লাবের বিভিন্ন কক্ষের ফ্যান, এসি, কম্পিউটার, সিসি ক্যামেরা, বেসিনের কল, কমোড, জানালার পর্দা, টেবিল, চেয়ারসহ বিভিন্ন আসবাব। এরসঙ্গে হামলাকারীরা নিয়ে গেছে সব ট্রফি। ক্রিকেট, ফুটবল, হকিসহ বিভিন্ন খেলায় এ পর্যন্ত যত ট্রফি জিতেছে আবাহনী – কিছুই আর অবশিষ্ট নেই!

ঢাকা আবাহনী বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের পরিচিত মুখ। দেশ ও দেশের বাইরে সাফল্যের সঙ্গে অসংখ্য ট্রফি জয়ের সাক্ষী ক্লাবটি। কিন্তু ক্লাবে ভাংচুর এবং ট্রফি চুরির ঘটনায় বেশ হতাশ ক্লাবের সাবেক খেলোয়াড়রা। প্রাণের ক্লাব আবাহনীর ট্রফিগুলো অন্তত ফিরিয়ে দেওয়ার আকুতি তাদের। সে আকুতি নিয়ে আজ ক্লাব প্রাঙ্গণে একত্রিত হন আবাহনীর হয়ে ক্রিকেট, ফুটবল, হকিসহ অন্যান্য খেলায় অংশ নেয়া সাবেক খেলোয়াড়রা।

আবাহনীর ফুটবল ও হকি দলের প্রথম অধিনায়ক ও সাবেক হকি তারকা আব্দুস সাদেক বলেন, “৫২ বছর আগে ১৯৭২ সালে আমি খেলি প্রথম ফুটবল ও হকি। দু’টি দলেরই প্রথম বছরের অধিনায়ক ছিলাম আমি। ৫২ বছর হয়ে গেলো এই ক্লাবে এসেছি। সামনে আমার কিছু ট্রফি দেখছি। ৫২ পর নিশ্চিতভাবে বলতে পারি আবাহনী ক্লাব হলো শ্রেষ্ঠ ক্লাব। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় ক’দিন আগে একটি অপ্রীতিকর ঘটনায় ক্লাব থেকে শতশত ট্রফি কে বা কারা নিয়ে গেছে। আমি আপনাদের মাধ্যমে অনুরোধ করবে, এই ট্রফিগুলো যাতে ক্লাবকে ফেরত দেওয়া হয়। এর বেশি কিছু চাচ্ছি না।”

আবাহনীর ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু বলেন, “আমি মর্মাহত। নিশ্চয়ই দুস্কৃতিকারী ছাড়া এরকম কাজ করতে পারে না। যে কোন মাধ্যমে হোক ট্রফিগুলো ফেরত চাই। আমাদের অনেকেই এখানে ষাটোর্ধ্ব বয়স। জানি না কতদিন বাঁচবো। জীবন থাকতে এই ট্রফিগুলো আবার দেখে যেতে চাই। সেটাই হবে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় পাওয়া। যারা জড়িত ছিলেন, আপনাদের ওপর আমাদের কোন ক্ষোভ নেই। আপনারা ট্রফিগুলো ফেরত দেন। এছাড়া সামনে ক্রিকেট-ফুটবল মৌসুম আসছে। আবাহনী যাতে বরাবরের মতোই ভালো দল গড়তে পারে, কর্মকর্তাদের যেন সেই সুযোগ দেওয়া হয়।”

আবাহনীর পরিচালক কাজী ইনাম আহমেদ বলেন, “আবাহনী অত্যন্ত ঐতিহ্যবাহী ক্লাব। অনেক খেলোয়াড়, কর্মকর্তা এখানে ছুটে এসেছেন। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, আমাদের ক্লাবে যে আক্রমনটা হয়েছে মনে অনেক ব্যাথা পেয়েছি। আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে আমাদের যে অর্জন, এতগুলো ট্রফি নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই যুব সমাজ, ছাত্ররা কিন্তু খেলা পছন্দ করে। আমাদের আবাহনী ক্লাবের সমর্থকগোষ্ঠীর বড় একটা অংশ ছাত্র ও তরুণ। আমার মনে হয় কিছু দুর্বৃত্ত এসব করেছে, ট্রফিগুলো যাদের কাছে আছে অনুরোধ করবো, এখানে যারা সাবেক খেলোয়াড় আছেন, তাদের জন্য, আমাদের সমর্থকদের জন্য ট্রফিগুলো ফেরত দিন।”

বাংলাদেশ জাতীয় দল ও আবাহনীর সাবেক ফুটবলার ও অধিনায়ক দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল বলেন, “এই ট্রফিগুলো বিক্রী করে কিন্তু খুব বেশি টাকা পাওয়া যাবে না। তবে আমরা এখানে যারা আছি, তাদের ৫২ বছরের প্রাপ্তি কিন্তু শেষ হয়ে যাবে। এখানে অনেকেই কিন্তু ক্লাব প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত নই। আমাদের এখানে আসার কারণটা একটাই আমরা বিভিন্ন সময় এই দীর্ঘ সময়ে আমাদের অর্জনগুলো আমাদের ফিরিয়ে দিন। আপনারা এই ট্রফিগুলো ঘরেও রাখতে পারবেন না। ঘরে রাখলে কেউ এসে প্রশ্ন করলে কোন সদুত্তরও দিতে পারবেন না। তাই আপনারা যদি এই ট্রফিগুলো ফিরিয়ে দিয়ে যান আমরা অত্যন্ত খুশি হবো।”

জাতীয় দল ও আবাহনীর সাবেক ফুটবলার আব্দুল গাফফার বলেন, “একটি ঘটনায় আমাদের ৫২ বছরের অর্জন নিয়ে গেছে। যারা নিয়ে গেছেন, তাদের কাছে অনুরোধ, এই অর্জনগুলো যাতে পরবর্তী প্রজন্মকে দেখাতে পারি, সেজন্য ফিরিয়ে দিন। সেটা যদি দেখাতে না পারি আপনারাই কষ্ট পাবেন। আপনারা ফিরিয়ে দিন। আশ্বস্থ করছি এখানে কোন খারাপ কিছু হবে না। ক্রীড়া উপদেষ্ঠার কাছে অনুরোধ আপনি ক্লাবগুলোকে সহায়তা করুন। নিরাপত্তা দিন।”

বাংলাদেশ জাতীয় দল ও আবাহনীর সাবেক ক্রিকেটার ও অধিনায়ক এবং বিসিবির পরিচালক খালেদ মাহমুদ সুজন বলেন, “এই ট্রফিগুলো তো কোন দোষ করেনি, আমরা যারা খেলেছি, ক্রিকেট, ফুটবল, হকি দলের হয়ে, আমরা তো দোষ করিনি। আবাহনীর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্মৃতি ছিল অনেক। ট্রফি কক্ষে যখন যেতাম, সেগুলো দেখে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়তাম। ট্রফির সামনে দাঁড়িয়ে বলতাম, এই বছর আমরা এই ট্রফি জিতেছি। ক্লাবে ভাঙচুর করেছে, কিন্তু ট্রফিগুলো কেন নিয়ে গেলো সেটা আমাদের কারই বোধগম্য নয়। এজন্য খারাপ লাগছে। অনুরোধ করি, ট্রফিগুলো রেখে কোন লাভ হবে না। এটা স্বর্ণের বা হিরার কোন ট্রফি নয়। তবে আমাদের কাছে এসব ট্রফি অনেক অমূল্য।”

প্রিয় ক্লাবের এমন অবস্থায় মর্মাহত সাবেক খেলোয়াড়রা। ক্লাবের ক্ষয়ক্ষতি ভুলে সাফল্যের স্বারক ট্রফি গুলো ফিরিয়ে দেওয়ার আকুতি তাদের। আর সে আকুতি নিয়ে আজ ক্লাব প্রাঙ্গণে একত্রিত হন বর্ষীয়ান ক্রীড়া সংগঠক আবদুস সাদেক, দেওয়ান শরিফুল আরেফিন টুটুল, আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি ও তারকা ফুটবলার আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু, আব্দুল গাফফার, শেখ মোহাম্মদ আসলাম, খুরশিদ আলম বাবুল, গোলাম গাউস, ইকবাল হোসেন, জাকির হোসেন, সত্যজিত দাস রুপু ও বিপ্লব ভট্টাচার্যরা। এছাড়া সাবেক ক্রিকেটারদের মধ্যে খালেদ মাহমুদ সুজন, গাজী আশরাফ হোসেন লিপু, দিপু রায় চৌধুরী, ইমরান হামিদ পার্থ, জাহিদ হোসেন শোভন উপস্থিত ছিলেন। এর বাইরে আবাহনীর অনেক সমর্থকও উপস্থিত ছিলেন।

Previous articleনিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায় সাবেকরা
Next articleদলবদলের সময় বৃদ্ধিতে ফিফা’র অসম্মতি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here