“সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল কি মধু আছে ওই তোমার নামেতে আহা ফুটবল”

‘ধন্যি মেয়ে’ সিনেমার জন্য প্রখ্যাত গায়ক মান্না দে’র গাওয়া এই গানটিই সম্ভবত ফুটবল নিয়ে বাঙালির সেরা গান। বাঙালির নিজস্ব দেশ বাংলাদেশ কিংবা ভাগের দেশ ভারতে ফুটবল এখন গৌন। বরং ক্রিকেট এখানে রাজত্ব করছে। আবার ক্রিকেট বিশ্বেও রাজত্ব করছে বাংলাদেশ ও ভারত। সে বিবেচনায় ক্রিকেট নিয়ে বাঙালির মাতামাতি থাকার কথা বেশি। যেখানে ফুটবলে বাংলাদেশের সর্বশেষ অবস্থান বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে ১৮৭, সেখানে বিশ্ব ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের আসর নিয়ে এখানে উন্মাদনা তো থাকার কথা না। কিন্তু ওই যে ‘সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল’! এখানে হালের শহুরে নেট প্রজন্ম বাদ দিলে এমন ক’জনাকে পাবেন যে কিনা কাদাজলে নেয়ে-মেখে ফুটবলে লাথি মারে নি! আর দশটা খেলায় বাঙালির দুনিয়াসেরা হওয়ার সুযোগ থাকলেও এবং নিকট ভবিষ্যতে বাঙালির ফুটবলে কোনো আশা না থাকলেও ফুটবলীয় আবেগের কমতি এখানে হবে না সহসাই- এটা চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়।

সেই ষাটের দশকের পেলে কিংবা আশির দশকের জিকোদের আমলের ব্রাজিলের লাতিন সাম্বা তালের ছন্দময় ফুটবল দেখেই তো বাঙালির ব্রাজিলপ্রীতির সূচনা। আর নিকট অতীতের রোনালদো-রোমারিও-রোনালদিনহো-কাকা… বাঙালিকে ব্রাজিল চিনিয়েছেন ওঁরাই। চোখজুড়ানো পাসিং ফুটবল, ফুটবলের যতোপ্রকার নান্দনিকতা তা সবই ব্রাজিলের সৃষ্টি। পাঁচবার বিশ্বকাপ জিতে আর এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সবক’টি বিশ্ব আসরে খেলে ফুটবলের রাজা এখন পর্যন্ত ব্রাজিলই। আবার আশির দশকের ফুটবলের বিশ্বনায়ক আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনা। অবসরের এতো পরে এসেও এখনও যার ফুটবল-পাগলামি উপভোগ করে আনন্দলাভ করেন খোদ বিপক্ষ-শিবিরের সমর্থকেরাও। আধুনিক ফুটবলের নায়ক বলতেই তো ম্যারাডোনা। সে ‘ঈশ্বরের হাতের গোল’ দিয়েই হোক বা ছোটখাটো নাদুসনুদুস ওই পায়ের ঝলকানিতেই হোক, ফুটবলকে মহিমান্বিত করেছেন তো তিনিই। তাই ম্যারাডোনাই যেন সর্বকালের ফুটবল-ঈশ্বর! আর হাল আমলের মেসি তো গত এক দশকের রাজা। বাঙালির আর্জেন্টিনা প্রীতির নায়ক তো তারাই! এদের কারণেই ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা বাংলাদেশের মানুষের ফুটবল দর্শনের মূল চাবিকাঠী। বাকিদের হিসাব কেবল ভগ্নাংশেই।

লাতিন ফুটবল বাদ দিলে ইউরোপের পর্তুগালের ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোও কম যান না। গত দশকের ফুটবল রাজত্বের সমান অংশীদার মেসির সাথে তিনিও। কিন্তু আফসোস! মেসি বা রোনালদোর কেউ এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপটাই ছুঁয়ে দেখতে পারলেন না! সামনে পারবেন কিনা সেটা সময় বলে দিবে।

বাংলাদেশে ফুটবল নিয়ে যে মাতামাতি, বিশেষ করে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল নিয়ে, এমন উন্মাদনা নাকি খোদ ওই দুটি দেশেও চলে না। এদেশের মানুষ ভালোবেসে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকা টাঙায়। কেউ কেউ তো জমি বেঁচে পছন্দের দলের পতাকা কেনে! কেউ পাঁচ কিলোমিটার লম্বা জার্মানির পতাকা বানায় তো কেউ আবার পুরো একটা বহুতল বাড়িকেই বানিয়ে ফেলে ব্রাজিলের পতাকা। আবার কেউ কেউ মেসি মেসি স্লোগানে মিছিল বের করে। ফুটবল এখানে এমনই ভালোবাসার ধন। এগুলো দেখতে চলে আসেন আবার ওইসব দেশের কর্তারা। এই তো ঢাকাস্থ জার্মান দূতাবাসের কর্তারা গেলেন মাগুরার সেই পাঁচ কিলোমিটার জার্মানির পতাকা ও পতাকাওয়ালাকে দেখতে। বাংলাদেশের আর্জেন্টিনাভক্তদের উন্মাদনার মিছিলের ভিডিওচিত্র নিজের টুইটারে পোস্ট করে কৃতজ্ঞতা জানালেন বিশ্বতারকা লিওনেল মেসি। আর ব্রাজিলের একটা টিভি চ্যানেল তো পুরোদস্তুর একটা টিম পাঠিয়ে কাভার করলো ঢাকা-মানিকগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জের ব্রাজিলপাড়াগুলো। সাথে দেশটির রাষ্ট্রদূতও ছিলেন। আবার ফুটবল নিয়ে এই উন্মাদনার মধ্যে ঘটে গেছে কিছু দুর্বিসহ দুর্ঘটনাও। উন্মাদনার মাত্রা কোথাও কোথাও এমনই মাত্রা ছাড়িয়েছে যে কোপাকুপির ঘটনাও ঘটে গেছে। তবে এর কতোখানি সত্য আর কতোখানি রঙ মাখানো সেটা নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই!

এই যে বাঙালির ফুটবল-উন্মাদনা, তা সত্বেও আমাদের নিজেদের ফুটবলের এতো করুণ অবস্থা কেন? আমরা আগে অন্তত সাফ ফুটবলে শীর্ষ অবস্থানে ছিলাম, সেখান থেকে নামতে নামতে নামতে এতো নিচে এসে ঠেকলাম কেন? কেন আজ দক্ষিণ এশিয়ায় মালদ্বীপ, ভুটান, শ্রীলংকা, নেপালের মতো দেশগুলোও আমাদের ছাড়িয়ে গেলো? কেন আমরা আজ ফিফা র‌্যাংকিংয়ে একেবারে তলানিতে এসে দাঁড়ালাম? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজাটাও তো জরুরি। এই যে ফুটবল নিয়ে একটা জাতির এই মাত্রায় উন্মাদনা যেটা বিশ্বের আর কোথাও সম্ভবত নেই, তাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের ফুটবল শক্তির জাগরণ কি একেবারেই সম্ভব ছিলো না? আমাদের ফুটবল কর্তারা ফুটবলের চেয়ে নিজেদের স্বার্থ নিয়ে এতো ব্যস্ত থেকেছেন যে তারা ফুটবলের দিকে মনোযোগী হওয়ার মতো সময়ই পাননি! কেন এমন হলো? এখন বোধহয় সময় এসেছে এসব ব্যর্থতার সুলুকসন্ধানের। আমাদের কর্তাদের দায় অনুধাবনের কোনো তাগিদই কি জন্মাবে না?

Previous articleসকল মনোনয়ন বৈধ ঘোষণা!
Next articleনাম প্রত্যাহার করলেন বাদল রায়!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here