মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশে প্রাণ। কেননা তাদের হাত ধরেই স্বাধীনতা লাভ করে আমাদের সকলের প্রিয় মাতৃভূমি। আর সেই মুক্তিযোদ্ধাদের নামে বাংলাদেশের পেশাদার ফুটবল লিগে থাকা ক্লাবটির নাম ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র’। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও উন্নতি তো হচ্ছেই না উল্টো দিন দিন আরো অবনতি হচ্ছে ক্লাবটির। বর্তমানে আর্থিক সংকটে নিদারুণ সময় কাটছে ক্লাবটির। পেশাদার ফুটবলে একটি ক্লাবের যে সকল সুযোগ বাধ্যতামূলক ভাবে থাকার কথা, তার কিছুই নেই এই ক্লাবটির। ধুঁকতে থাকা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র যেন সময়ের স্রোতে হারিয়ে যাওয়ার পথে!

অথচ বাংলাদেশের ফুটবলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের রয়েছে বিশাল ইতিহাস। বাংলাদেশে যে ক’টি পুরাতন ক্লাব রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম এই ক্লাবটি। ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত ক্লাবটি বর্তমানে দূরাবস্থায় থাকলেও এক সময় সামনের সারির ক্লাবগুলোর সাথে সমানে লড়াই করতো। এই মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র থেকেই বের হয়ে এসেই বাংলাদেশ জাতীয় দলে আলো ছড়িয়েছেন বহু ফুটবলাররা। একসময়কার ফুটবলার তৈরির কারখানা হিসেবে পরিচিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র আজ যেনো নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই হিমশিম খাচ্ছে।

অথচ ১৯৯০-২০০৫ পর্যন্ত ঘরোয়া কি আন্তর্জাতিক, সব অঙ্গনেই কি দারুন সফলতাই না ছিলো ক্লাবটির। ১৯৯৪, ২০০১ ও ২০০৩ সালের ফেডারেশন কাপের শিরোপা জয়ের পাশাপাশি ২০০৩ সালের আরেক টুর্নামেন্ট জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপেরও শিরোপা জেতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের ১৯৯৭-৯৮ ও ২০০০ সালের চ্যাম্পিয়ন দলটির নামও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র। শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরেও সাফল্যের সাক্ষর রেখেছে মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৯৮ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত ম্যাকডয়েল কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে শিরোপা বাংলাদেশে নিয়ে আসে মুক্তিযোদ্ধা। এছাড়াও একই বছরে ভারতেই স্বাধীনতা দিবস কাপে রানার্স আপ হয় মুক্তিযোদ্ধা। এর আগে ১৯৯২ সালে সিকিম গোল্ড কাপেও রানার্স আপ হয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র। এছাড়াও এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, এএফসি কাপে ও এশিয়ান উইনার্স কাপে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে ক্লাবটি।

এতো রঙিন ফুটবল ইতিহাস সমৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র এখন দল গড়ে কোনরকম ভাবে টিকে থাকার জন্য। এই মৌসুমের জন্য গড়া দলেও নেই তেমন কোনো বড় নামের ফুটবলার। গড়পড়তা দল নিয়ে কোনরকম ভাবে লিগে টিকে থাকাই যেনো এখন মুক্তিযোদ্ধার লক্ষ্য। অথচ এই মুক্তিযোদ্ধাই একসময় চ্যালেঞ্জ জানাতো আবাহনী-মোহামেডানকে! ২০২১-২২ মৌসুমের জন্য মুক্তিযোদ্ধা বিদেশি কোটায় দলভুক্ত করেছে গিনির ইউনুসা কামারা, মিশরের সালসাদিন শামস ও দুই জাপানিজ টেটসু ও সোমাকে। এছাড়া দেশীয় ফুটবলারদের মধ্যে বড় নামের কাউকে দলে ভেড়াতে পারেনি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র। এই দল নিয়ে স্বাধীনতা কাপের গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছিল ক্লাবটি। আর মাঠ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে ফেডারেশন কাপ বর্জন করায় মরার ওপর খারার ঘা হিসেবে ৫ লাখ টাকা জরিমানা ও পরবর্তী মৌসুমের ফেডারেশন কাপে নিষিদ্ধ হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র। এমনিতেই আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত ক্লাবটি না আবার দেউলিয়া হয়ে যায় সেই শঙ্কাও উকি দিচ্ছে দর্শকদের মনে। গত মৌসুমেও কোন রকমে রেলিগেশন এড়ায় দলটি। ১৩ দলের মধ্যে দশম হয়ে মৌসুম শেষ করে মুক্তিযোদ্ধা। লীগে ২৪ ম্যাচে মাত্র ৪টি জয়ের দেখা পেয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা। ৭টি ম্যাচে ড্র করতে পেরেছিল আর বাকি ১৩টি ম্যাচে পরাজয়ের তিক্ত স্বাদ নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয় মুক্তিযোদ্ধাকে। গত মৌসুমে অবশ্য ক্লাবটির লীগে অংশ নেয়াই অনিশ্চিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল আর্থিক সংকটের কারণে। তবে সেবার দলটির ত্রাতা হিসেবে আবির্ভাব হন দলটির জাপানিজ ফুটবলার ইউসুকে কাতো। নিজে উদ্যোগ নিয়ে সেবার সিঙ্গাপুরের এক কোম্পানিকে স্পন্সর হিসেবে আনেন এই কাতো।

কিন্তু বছর ঘুরে নতুন মৌসুম শুরু হলেও বদলায় নি মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবের চিত্র। স্পন্সরের অভাবে এবারও আর্থিক দূরাবস্থায় বাজে সময় পার করছে ক্লাবের ফুটবলাররা। অর্থের অভাবে খেলোয়াড়রা অনুশীলন পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। বিভিন্ন সূত্রের খবর অনুযায়ী ইতিমধ্যেই দুই-তিন মাসে বাসা ভাড়া বাকির পাশাপাশি কাঁচাবাজারে প্রায় ৬ লাখ টাকা দেনা রয়েছে ক্লাবটির। এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধার ফুটবলারদের আরেকটি গুরুতর অভিযোগ ক্লাব সভাপতি জহিরুল ইসলাম রোহেল ক্লাবের খোঁজই রাখেন না। স্বাধীনতা কাপে ক্লাব সভাপতি একটি ম্যাচেও মাঠে আসেননি বলে অভিযোগ ফুটবলারদের। এমনকি ক্লাব সভাপতির সঙ্গে ফুটবলাররা দেখা করতে চাইলে সেটিও তিনি করেন না বলে অভিযোগ তুলেন ফুটবলাররা। এমন অবস্থা চলতে থাকলে দেশের ফুটবল থেকে মুক্তিযোদ্ধার মত ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের হারিয়ে যাওয়া শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার।

Previous articleটিকে থাকাই যেনো মূল লক্ষ্য উত্তর বারিধারার!
Next articleহ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা সালাম মুর্শেদী!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here