নাহিয়ান অন্তিক : সবকিছুরই একটা শুরু থাকে। বাঙালির পায়ে প্রথম ফুটবলের ছোয়া লাগে তখন সালটা ১৮৭৮! নগেন্দ্র প্রসাদ নামের এক ছাত্র বন্ধুদের কাছ থেকে মাত্র ত্রিশ পয়সা চাঁদা তুলে ইংরেজ দোকানীদের কাছে যায় ফুটবল কেনার আশায়। তারা ফুটবল হাতে পেয়ে মাথা চুলকায়। কারন তারা জানেও না ফুটবল খেলার নিয়মটা আসলে কি! না জানলেই বা কি! আজ তাদের ফুটবল খেলতেই হবে! হিন্দু স্কুল আর প্রেসিডেন্সি কলেজের মাঝে একটা মাঠে তারা খেলতে নামে। খেলা শুরু হলো। বল রেখে একজন আরেকজনকে লাথি মেরে শুইয়ে ফেলতে শুরু করলো। এ যেনো ফুটবল নয় রাগবী খেলা চলছিলো সেখানে! পাশের রাস্তা দিয়ে হেটে যাওয়া মানুষেরা হা করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা শুরু করলো এবং ভাবতে শুরু করলো,“কি বাপু! এখানে কি চলে! মারামারি করছে কেনো এই ছেলেগুলো!”
শব্দ শুনে আশেপাশের পাড়ার মানুষও এসে জড়ো হতে শুরু করলো। সবারই মনে এক আলাদা রঙের ছোয়া লেগে গেলো সেদিন। তারপর ধীরে ধীরে এভাবে কয়েকদিন পাড়ায় পাড়ায় চলতে থাকলো ফুটবল নিয়ে রাগবি খেলা। তারপর ধীরে ধীরে বাঙালীরা জানতে পারলো খেলার নিয়ম এবং সেই নগেন্দ্র প্রসাদই প্রথম ১৮৮৪ সালে ওয়েলিংটন ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরে এটার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় টাউন ক্লাব। নগেন্দ্র প্রসাদের হাত ধরেই শুরু হয় ভারতবর্ষে ফুটবলের যাত্রা।
এরপর ১৮৮৫ সালে শোভাবাজার ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। এদিকে ১৮৯০ সালের দিকে ঢাকা কলেজ ঢাকায় গড়ে তোলে ওয়েলিংটন ক্লাব। পরে যেটার নাম দেয়া হয় ওয়ারি ক্লাব। তার সাথে ধীরে ধীরে আরো অনেক ক্লাব গড়ে উঠলো ঢাকায়। এভাবে ধীরে ধীরে অনেক ক্লাব গড়ে ওঠে এবং ভারতবর্ষে একটা ক্লাবদের নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রয়োজন হয়ে ওঠে। আবারো এলেন সেই নগেন্দ্র প্রসাদ। ১৮৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত করলেন আইএফএ(ইন্ডিয়ান ফুটবল এসোসিয়েশন)। এরপর যতোগুলো প্রতিযোগিতাই আইএফএ আয়োজন করেছে সবগুলোয় উঠেছে ইংরেজ ক্লাবগুলোর হাতে। খালি পায়ে বুটছারা তখনো যে রপ্ত করে উঠতে পারেনি খেলাটা বাংলার দামাল ছেলেরা।
এরপর ১৯১৯ সালে মোহনবাগান কলকাতায় প্রথম ইংরেজদের দুর্গ ভেঙে চুরমার করে দেয়। আইএফএ শিল্ড প্রথমবার বাঙালিদের ঘরে ওঠে সেবার। মোহনবাগানের সেই দলের ১১ জনের ভেতর ১০ জনই ছিলেন পুর্ব বাংলার বাঙালি। এদিকে দেখা গেলো পুর্ব বাঙলার বাঙালিরাই যেনো ফুটবলটা একটু বেশি পেরে উঠছে। তাই সে থেকে ১৯৩৩ সালে ঢাকার পল্টন ময়দানে ছোট্ট একটা টিনের ঘরে গড়ে উঠল ডিএসএ(ঢাকা স্পোর্টিং এসোসিয়েশন)। এদিকে পল্টন ময়দানেই ছিলো তখনকার ঢাকার তিনটি সবচেয়ে বড় ক্লাব ওয়ারি ক্লাব,ভিক্টোরিয়া ক্লাব এবং লক্ষিবাজার ক্লাবের খেলার মাঠ। ক্লাবগুলো মাঠকে টিন দিয়ে তিনভাগ করে নিয়েছিলো নিজের মতো করে। ডিএসএ প্রতিষ্ঠার পর আন্ত:স্কুল এবং আন্ত:কলেজ টুর্নামেন্টগুলো চালু করে দেয় এবং বর্তমান গুলিস্তানের জিপিও পোস্ট অফিস ছিলো তখন এই টুর্নামেন্টের জন্য নির্ধারিত মাঠ।
তখনকার দিনে ফুটবলকে পুরো পৃথিবীর কাছে পৌছে দেয়ার জন্য ইংল্যান্ডের আইলিংটন করিন্থিয়ান্স সারা পৃথিবীতে খেলে বেড়াতো। ১৯৩৬ সালে যখন তারা ভারতবর্ষে আসে তখন পর্যন্ত তারা ইংল্যান্ডের বাইরে একটি ক্লাবের সাথেও হারেনি। ১৯৩৬ সালে তারা প্রথমে এসে খেললো কলকাতা মোহামেডানের সাথে। ইতিহাসের সেদিনই প্রথম তারা ড্র করলো কোন ইংল্যান্ডের বাইরের ক্লাবের সাথে। এরপর ১০ নভেম্বর ঢাকায় তাদের খেলা ছিলো ডিএসএ একাদশের সাথে। করিন্থিয়ান্সদের ইতিহাসের প্রথম হারের স্বাদটা দিয়েছিলো সেদিন ঢাকার বাঙালিরা। ১-০ গোলে হারিয়েছিলো ডিএসএ একাদশ করিন্থিয়ান্সদের। খেলোয়াড়দের অধিকাংশই ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সেদিন মাঠে ইংরেজদের হারতে দেখে বিজয় উল্লাসে মেতে উঠেছিলো হাজারো মানুষ। তবে ইংরেজরা যাবার বেলায় স্বীকার করে গিয়েছিলো এই বলে,“অনেক শুনেছিলাম বাংলার বাঘের কথা! এবার তা দেখে গেলাম!”
এরপর ডিএসএ এর অধীনে কলকাতা এবং ঢাকার ফুটবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়ে যায়। কলকাতা থেকে দল এসে হেরে যেতো বাংলার মাটি থেকে। ১৯৩৩ থেকে দেশ বিভাগের আগ পর্যন্ত ঢাকার ফুটবল লীগে যেসব ক্লাব অংশগ্রহণ করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ওয়ারী ক্লাব, ভিক্টোরিয়া এসসি, লক্ষিবাজার ক্লাব, ইস্ট এন্ড ক্লাব, সেন্ট্রাল জেল একাদশ, আরমানী টোলা ক্লাব, রমনা এসি, ঢাকা মুসলিম ওয়ান্ডারার্স (ঢাকা ওয়ান্ডারার্স), মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, তেজগাঁও ফ্রেন্ডস ইউনিয়ন, ঢাকেশ্বরী কটন মিলস, মনিপুর ফার্ম, বিজিএইচ।
সোনালী এক সময় পার করে আজ খরস্রোতা এক নদীর মতো কোনভাবে টিকে আছে বাংলার ফুটবল। ফিরে আসুক সেই সোনালী দিনগুলো এই শুধু কামনা এখন।